ঢাকা, ১৩ জুলাই ২০২৫:
বিয়ে মানে শুধু দুটি মানুষের সম্পর্ক নয়, এটি দুটি মন, দুটি পরিবার এবং একটি সামাজিক কাঠামোর মেলবন্ধন। যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে এমন একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে—ছেলের বয়স মেয়ের থেকে বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন অনেক দম্পতিকে দেখা যায়, যেখানে মেয়ের বয়স ছেলের চেয়ে বেশি। ফলে প্রশ্ন উঠছে—এতে কি দাম্পত্য জীবনে সমস্যা হয়?
বিয়েতে বয়স কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ? বয়সে বড় স্ত্রী আর ছোট স্বামী নিয়ে সমাজ কী ভাবে? আর বাস্তব জীবনে তাদের দাম্পত্য কেমন চলে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমাদের আজকের এই প্রতিবেদন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্পর্কের ভিত্তি বয়স নয়, বরং মানসিক পরিপক্বতা, বোঝাপড়া এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা। বয়স যদি মাত্র ২–৫ বছরের বেশি হয়, তাহলে সেটি খুব বড় ফারাক নয় বলেই ধরা হয়। কিন্তু যখন ব্যবধান আরও বাড়ে, তখন কিছু বিষয় সামনে চলে আসে।
মনোবিজ্ঞানী ডা. সোহেল রানা বলেন, “বয়সের ব্যবধান তখনই সমস্যা হয়, যখন একজন অন্যজনকে বুঝতে ব্যর্থ হয়। যদি স্ত্রী বয়সে বড় হন, তাতে কোনো সমস্যা নেই, যদি দু’জন মানসিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হন।”
তিনি আরও বলেন, “ছেলেটি যদি আত্মবিশ্বাসী হয় এবং মেয়েটিও যদি একে অপরকে সম্মান করে, তাহলে বয়স কোনো ইস্যুই নয়।”
তবে সমাজের চাপ অনেক সময় বড় হয়ে দাঁড়ায়। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধবদের নানা মন্তব্য দম্পতির ওপর মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। যদি তারা একে অপরকে ঠিকভাবে বুঝতে না পারে, তবে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ে।
বিয়ের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—পারস্পরিক বোঝাপড়া। একজন আরেকজনের অনুভূতি বুঝতে পারা, সময় দেওয়া এবং বিশ্বাস রাখাই একটি সম্পর্কের মূল স্তম্ভ।
যেসব দম্পতির মধ্যে স্ত্রীর বয়স বেশি, তাদের অনেকেই জানান—বিয়ের শুরুতে অনেক বাঁধা পেরোতে হয়েছে। কারও পরিবার রাজি হয়নি, কেউ হয়তো বন্ধুদের উপহাসের শিকার হয়েছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন সম্পর্ক মজবুত হয়, তখন সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে যায়।
বিশ্বখ্যাত সেলিব্রেটিদের মধ্যেও এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। বলিউড থেকে হলিউড—এমন বহু তারকা দম্পতি রয়েছেন, যাদের মধ্যে স্ত্রীর বয়স স্বামীর চেয়ে অনেক বেশি। তবুও তাদের সম্পর্ক সুন্দরভাবে এগিয়ে চলেছে।
ইসলামের ইতিহাসেও এমন উদাহরণ আছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রথম স্ত্রী খাদিজা (রা.)-কে বিয়ে করেন, যিনি বয়সে ছিলেন নবীজির চেয়ে ১৫ বছর বড়। তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত সফল ও সুখী।
অনেক সময় ছেলেরা মনে করে, বয়সে বড় মেয়েকে বিয়ে করলে তাদের কর্তৃত্ব নষ্ট হবে। আবার মেয়েরাও ভয় পায়—স্বামী যদি বয়সের কারণে অবজ্ঞা করে। এই মানসিক দ্বন্দ্বই সমস্যার মূল।
তবে বাস্তবতা হলো—যখন ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা থাকে, তখন বয়স গৌণ হয়ে যায়। বয়সের পার্থক্য থাকলেও সম্পর্ক হয়ে ওঠে গভীর এবং পরিপূর্ণ।
সামাজিক বাস্তবতার দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের দেশে এখনো এমন বিয়ে সহজভাবে মেনে নিতে পারে না অনেকে। মেয়ের বয়স বেশি জানলে ছেলের পরিবারের মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়। তারা ভাবেন—“লোকজন কী বলবে?”
আবার অনেকে মনে করে, ভবিষ্যতে সন্তান নেওয়ার সময় বয়স বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদিও বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এসব অনেকটাই নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বয়স নয়, সম্পর্কের গুণমানটাই আসল। স্বামী ও স্ত্রী যদি একে অপরের প্রতি সৎ, দায়িত্ববান ও শ্রদ্ধাশীল হন, তাহলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন কিছু নয়।
তবে সমস্যা তখনই হয়, যখন সমাজের নেতিবাচক মন্তব্য দম্পতির মাঝে বিভেদ তৈরি করে। তাই তাদের উচিত একে অপরের পাশে থাকা এবং বাইরের কথায় গুরুত্ব না দেওয়া।
বর্তমান প্রজন্ম অনেক বেশি মুক্তমনা। তারা জানে—ভালোবাসা বয়স দেখে আসে না। তারা চায় সমতা, সম্মান এবং স্বাধীনতা।
তবে এই পথ সহজ নয়। সামাজিক বাঁধা, পারিবারিক অনীহা, এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব অনেক সময় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
এই চ্যালেঞ্জ জয় করতে হলে প্রয়োজন দু’জনের মনোবল, ভালোবাসা এবং একে অপরের প্রতি অটল বিশ্বাস। এছাড়াও প্রয়োজন পরিবার এবং বন্ধুমহলের সমর্থন।
দাম্পত্য জীবন এমন এক যাত্রা, যেখানে বয়স নয়, বরং দুটি হৃদয়ের মিলনই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে বয়স বড় হলে সমস্যা নয়—সমস্যা তখনই হয়, যদি সম্মান আর বোঝাপড়ার অভাব থাকে।
এই বিষয়ে এক বিবাহিত দম্পতি বলেন, “আমি স্ত্রীর চেয়ে ৫ বছর ছোট। কিন্তু আমার কাছে সে একজন বন্ধু, সাথি এবং পথপ্রদর্শক। আমরা একে অপরকে পূর্ণ করি।”
এই ধরনের ভালোবাসাই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ভবিষ্যতে হয়তো এমন দম্পতি দেখা যাবে আরও বেশি, যারা বয়স নয়, মন দিয়ে সম্পর্ক গড়বেন।
পরিশেষে বলা যায়, বয়সে বড় স্ত্রী মানেই দাম্পত্যে সমস্যা—এই ধারণা ভুল। বরং সমস্যা হয় যখন মনের দূরত্ব তৈরি হয়। আর যদি মন এক হয়, বয়স তখন শুধুই সংখ্যা।