দুজনকে পিটিয়ে হত্যা : ‘এ্যালা মুই কেমন করি বাঁচিম, কার কাছোত বিচার চাইম’

গণপিটুনিতে নিহত রংপুরের তারাগঞ্জের রুপলাল দাসের স্ত্রী ও বৃদ্ধ মায়ের আহাজারি। আজ রোববার সকালে তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামে

১০ বছর বয়সী মেয়ে রুপা দাস ও ১৩ বছর বয়সী ছেলে জয় দাসকে জড়িয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন ভারতী দাস। বুক ভেঙে কান্না আর বিলাপে তিনি বলছিলেন, ‘এ্যালা মুই কেমন করি বাঁচিম? ছোট ছাওয়া দুইটাক কায় খাওয়াইবে পড়াইবে? মোর নির্দোষ স্বামীক কেন মারিল, বেটিটার বিয়ার কী হইবে? মুই কোনটে যাইম, কী করিম? কার কাছোত বিচার চাইম?’

বড় মেয়ে নুপুর দাস (১৮) মায়ের গলা ধরে কাঁদছিলেন। তাঁর কণ্ঠেও অসহায়ত্বের হাহাকার, ‘এ্যালা কয় হামাক দ্যাখপে, কায় মাও কয়া দাকপে, হামরা যে এতিম হয়া গেইনো।’

ছেলে হারিয়ে বৃদ্ধ লালিচা দাস (রুপলালের মা) কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। প্রতিবেশীরা তাঁর মুখ ও মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফেরান। তারপরও কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘মোর ছেলেটার দোষ কী? কেন ওক দাংগে মারিল? মোর বাবা তো কারও ক্ষতি করত না। হামাক দ্যাখপার যে আর কায়ও থাকিল না। যায় মোর ব্যাটাক মারছে, তাঁর বিচার চাও।’

রুপলাল দাসের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামে। গতকাল শনিবার রাত ৯টার দিকে সয়ার ইউনিয়নের বটতলা এলাকায় গণপিটুনিতে নিহত হন তিনি। একই ঘটনায় নিহত হন তাঁর ভাগনির স্বামী প্রদীপ দাস।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রুপলাল দাস (৪০) স্থানীয় বাজারে জুতা সেলাই করতেন। ছোট্ট একটি টিনের ঘরে তিনি মা, স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ থাকতেন। অল্প আয়ে ছয়জনের সংসার চালাতেন। সহায় সম্বল বলতে চার শতক জমি। প্রদীপ দাস (৩৫) মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের বাসিন্দা। জীবিকা নির্বাহ করতেন ভ্যান চালিয়ে।
আজ রোববার সকালে ঘনিরামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রুপলালের বাড়িতে চলছে আহাজারি, শোক। স্বজনেরা বলছেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তাঁরা দিশাহারা।

নিহত ব্যক্তিদের পরিবার, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিঠাপুকুর উপজেলার শ্যামপুর এলাকার এক তরুণের সঙ্গে রুপলাল দাসের মেয়ে নুপুর দাসের বিয়ে কথাবার্তা চলছিল। আজ বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা ছিল। এ জন্য মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান চালিয়ে আত্মীয় রুপলাল দাসের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন প্রদীপ দাস। কিন্তু গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা না চেনায় প্রদীপ দাস সয়ার ইউনিয়নের কাজীরহাট এলাকায় এসে রুপলালকে ফোন করেন। রুপলাল সেখানে যান। তাঁরা দুজনে ভ্যানে চড়ে রুপলালের বাড়ি ঘনিরামপুর গ্রামের দিকে রওনা হন। রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছলে ভ্যানচোর সন্দেহে তাঁদের দুজনকে থামান স্থানীয় কয়েকজন। এরপর সেখানে লোক জড়ো হতে থাকে।

পরিবার, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে আরও জানা গেছে, গত ২৮ জুলাই ওই এলাকায় এক শিশুকে হত্যা করে একটি ভ্যান চুরি করা হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ ছিলেন। একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন প্রদীপ দাসের ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে চারটি প্লাস্টিকের ছোট বোতল বের করেন। সেগুলোতে চোলাই মদ ছিল বলে পরিবারের ভাষ্য। একটি বোতল খুললে ভেতরে থাকা তরলের ঘ্রাণে সেখানকার দুই ব্যক্তি অসুস্থ বোধ করেন বলে জানান। এ ঘটনায় লোকজনের সন্দেহ আরও বাড়ে। অজ্ঞান করে ভ্যান চুরি সন্দেহে তাঁদের মারধর শুরু করেন। বটতলা থেকে মারতে মারতে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নিয়ে আসা হয় তাঁদের। মারধরের একপর্যায়ে অচেতন হলে সেখানে ফেলে রাখা হয়। পরে রাত ১১টার দিকে তাঁদের উদ্ধার করে পুলিশ তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়।

হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক রুপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপ দাসকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে আজ ভোরে তিনিও মারা যান বলেন নিশ্চিত করেছেন নিহত রুপলাল দাসের ভাই খোকন দাস।

ঘনিরামপুর গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘রুপলাল দীর্ঘদিন ধরে তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন। তিনি কখনো কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করেননি। তাঁকে যেভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা অমানবিক। এ ঘটনায় ন্যায়বিচার হওয়া উচিত।’

তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, নিহত রুপলালের নামে থানায় কোনো মামলা নেই। তাঁর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।

কুর্শা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তুহিনুর ইসলাম বলেন, ‘রুপলাল দাস দিন করে দিন খায়। তাঁর মেয়ের বিয়ের কথা ছিল। তাঁকে মেরে ফেলায় পুরো পরিবার অসহায় হয়ে পড়েছে। আল্লাহ ভালো জানে, তাঁদের সংসার এখন কেমন করে চলবে। তাঁর সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তা মানবজাতি হিসেবে কোনোভাবেই কাম্য নয়।’

Check Also

সৌদিতে প্রবাসীর মৃত্যু: মরদেহ আনতে সরকারি সহায়তার আবেদন স্ত্রী-সন্তানের

মৃত মহসিন উপজেলার পোপাদিয়া ইউনিয়নের পূর্ব সৈয়দনগরের বাসিন্দা। সৌদি আরবের রিয়াদে জয় মাহিয়ান ডিস্ট্রিকের রস্তানুরা …

‘চাঁদাবাজ দখলদাররা কেউ বিএনপির লোক না’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, দুষ্টু কিছু মানুষ আছে, তাদের দুষ্টু কাজের জন্য আমাদের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *